বিষয়ঃ ২
একজনকে বাদ দিয়ে দুজনে কানাকানি কথা বলা
আমাদের পরিচিত একজনের ওলিমার দাওয়াত খেতে এসেছি। সাথে আছে হাসিব আর জাবের। ব্যস্ততার কারণে বন্ধুদের সাথে খুব একটা সময় কাটানো হয় না। এজন্য মাঝে মাঝে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। কিন্তু আজ বহুদিন পর তাদের কাছে পেয়ে এই নিঃসঙ্গতা অনেকটা বিদূরিত হয়ে গেল।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ। তিনজনে মিলে বসে গল্প করছি। বিভিন্ন বিষয়ের উপর গল্পের আসর জমে উঠেছে। বহুদিন পর সাক্ষাৎ-এর কারণে গল্পগুলো বিভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। আর সেই গল্পের বিষয়বস্তুগুলো প্রত্যেককেই এই আসরে বেঁধে রেখেছে। বিরক্তিভাব কারো মাঝেই প্রকাশ পায়নি; বরং উৎফুল্লতার সাথে প্রত্যেকেই গল্পের আসরে ডুবে ছিল।
গল্পের মাঝখানে জাবের আমাকে বললো, ❛তোর সাথে কিছু কথা আছে; একটু এদিকটায় আয় তো।❜ আমি কোন সংকোচবোধ না করেই তার সাথে চলে গেলাম। আর এদিকে হাসিব একা একা বসে আছে। আর আমরা তার থেকে প্রায় ১৫/২০ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।
কথাগুলো খুব একটা বেশি প্রাইভেটও নয়; জাবেরের পারিবারিক কিছু কথা। চাইলে সে হাসিবের সামনেই তা বলতে পারতো। কিন্তু সে তা না করে আমাকে একা এনে চুপিচুপি বললো।
জাবের তার মত করে বলে যাচ্ছে। আর আমি বারবার হাসিবের দিকে তাকাচ্ছি। কেননা, আমি এটা জানি, একসাথে তিনজন থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে এভাবে কানাকানি কথা বলা নিষেধ। এ জন্যই মূলত হাসিবের দিকে আমার নজরদারি। লক্ষ করে দেখলাম, কেমন জানি মনমরা হয়ে বসে আছে। সে মনে মনে হয়তো ভাবছে- আমরা তার ব্যাপারে কোন কথা বলছি।
আমি কোন ধরনের কালবিলম্ব না করে, জাবেরের হাত ধরে হাসিবের কাছে নিয়ে আসলাম। অতঃপর বললাম, ❛তোর যা বলার এখানে হাসিবের সামনেই বল। তুই কেন শুধু শুধু কানাকানি কথা বলার জন্য আমাকে আড়ালে নিয়ে গেলি? জানিস না, এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।❜
হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন……
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
{إِذَا كُنْتُمْ ثَلاَثَةً فَلاَ يَتَنَاجَى رَجُلاَنِ دُونَ الآخَرِ، حَتَّى تَخْتَلِطُوا بِالنَّاسِ، أَجْلَ أَنْ يُحْزِنَهُ}
❛ কোথাও তোমরা তিনজনে থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দু’জনে কানে-কানে কথা বলবে না। এতে তার মনে দুঃখ হবে। তোমরা পরস্পর মিশে গেলে তবে তা করাতে দোষ নেই। ❜ ➊
কথাগুলো খুব বেশি একটা প্রাইভেট ছিল না। তাই জাবের অবশেষে আমাদের দু’জনের সামনেই তার কথাগুলো শেয়ার করলো। কিন্তু প্রথমে সে বড় একটি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছিল। আমি যদি তাকে বলার সুযোগ দিতাম, তাহলে হাসিব মনে মনে অনেক কষ্ট পেত। মনে করতো-তার নামে আমরা বদনাম করছি অথবা এমন কথা বলছি, যেটা শোনার যোগ্যতা তার নেই। এতে সে হীনমন্যতায় ভুগতো।
[ গল্প থেকে শিক্ষা ]
১। আমাদের সমাজে এই জিনিসটা খুব বেশি প্রচলিত। প্রায়ই আমরা একজনকে বাদ দিয়ে পরস্পর কানাকানি করে থাকি। অথচ, এদিকে খেয়াল রাখি না, হয়তো সে মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। তাই আমাদের উচিত, এভাবে কথা বলার আগে নিজেকে ঐ স্থানে ভেবে নেয়া।
২। একবার আপনি নিজেকে ওই স্থানে রেখে ভাবুন। ভেবে দেখুন, আপনাকে বাদ দিয়ে দু’জন আপনার সামনে কানাকানি করছে আর আপনি দূর থেকে তা প্রত্যক্ষ করছেন। শুধু দেখেই যাচ্ছেন। এছাড়া আপনার আর কিছু করার নেই। এমতাবস্থায় আপনার কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে! খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। কেননা, কেউ- ই চায় না, আমার সামনে আমাকে বাদ দিয়ে দু’জন পরস্পর কানাকানি করুক।
৩। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এর কারণগুলো হচ্ছেঃ
- এই ধরনের ব্যবহার কারো সাথে কাম্য নয়, আর দেখতে বাজে দেখায়।
- এতে শিষ্টাচারও লঙ্ঘন হয়। আর কানাকানি করাও অশোভনীয় এবং অভদ্রতার পরিচয় দেয়।
- অন্যের মনে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি, অথবা আঘাত দেওয়ার এবং অবশেষে তার মনোক্ষুন্ন করার অধিকার আপনার আমার নেই।
- তৃতীয় ব্যক্তি নিজের মধ্যে দুর্ভাবনায় পড়ে যায়। দুঃখ করে এই জন্য সে হয়ত অযোগ্য পরামর্শ দাতা হিসেবে।
- সে আপনাদের প্রতি কুধারণা করবে। হয়তো বা মনে করবে যে, আপনারা তারই বিরুদ্ধে কিছু বলছেন অথবা আপনারা তার নিকট কোন কথা গোপন করতে চাচ্ছেন এবং সে আমানতে খেয়ানতের ব্যাপারে তাকে সন্দেহ করছেন।
[ কুরআনে বর্ণিত আদেশ ]
কানাঘুষার ব্যাপারে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনের মধ্যে উল্লেখ করছেনঃ
اِنَّمَا النَّجۡوٰى مِنَ الشَّيۡطٰنِ لِيَحۡزُنَ الَّذِيۡنَ اٰمَنُوۡا
❛ এই কানাঘুষা তো শয়তানের কাজ; (তা এ জন্য করে) যাতে ঈমানদারদের দুঃখ দিতে পারে। ❜ (সূরাহ্ আল-মুজাদালাহ্, ৫৮ঃ১০)
[ করণীয় ]
এখানে আরো বলা যায় এভাবে, আপনারা দুইজন এক ভাষার হলে এবং অপরজন অন্য ভাষার হলে এবং সে আপনাদের ঐ ভাষা না বুঝলে যে ভাষা সবাই বুঝে সেই ভাষাতেই কথা বলা উচিত। এ ক্ষেত্রে আপনার নিজেদের ভাষায় সশব্দে তার সামনে কথা বললেও তার মনে কষ্ট হবে। অতএব সেখানেও এই আদবের খেয়াল রাখুন।
এজন্য আমাদের এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, যদি তিনের বেশী লোক থাকে, তাহলে দুই জনের চুপে চুপে অথবা একটু সরে গিয়ে কানে কানে কথা বলা দূষণীয় নয়।
[ উৎস ]
বইঃ জীবনের আয়না
লেখকঃ মাহমুদ বিন নূর
প্রকাশকঃ রাইয়ান প্রকাশন