কোন আল্লাহ্’র ওলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করা অথবা তাঁকে যে কোনভাবে কষ্ট দেয়া

[ প্রারম্ভিক কথা ]

কোন আল্লাহ্’র ওলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করা অথবা তাঁকে যে কোনভাবে কষ্ট দেয়াও আরেকটি কবীরা গুনাহ্। কারণ, তাদেরকে কষ্ট দেয়া মানে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে কষ্ট দেয়া। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে কষ্ট দিবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁর রহমত থেকে বঞ্চিত করবেন এবং আখিরাতে রয়েছে তার জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«إِنَّ الَّذِيْنَ يُؤْذُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ لَعَنَهُمُ اللهُ فِيْ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَأَعَدَّ لَـهُمْ عَذَابًا مُّهِيْنًا»

‘‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কষ্ট দেয় আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লা’নত করবেন এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাকর শাস্তি’’। (সূরাহ্‌ আল-আহযাব, ৩৩ঃ৫৭)

 

[ হাদিস ]

আবূ হুরাইরাহ্ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন…… রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

إِنَّ اللهَ تَعَالَى قَالَ: مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْـحَرْبِ، وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِيْ بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِيْ يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِيْ يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِيْ يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِيْ يَبْطِشُ بِهَا، وَرِجْلَهُ الَّتِيْ يَمْشِيْ بِهَا، وَإِنْ سَأَلَنِيْ لَأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَـاذَنِيْ لَأُعِيْذَنَّهُ، وَمَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ تَرَدُّدِيْ عَنْ نَفْسِ الْـمُؤْمِنِ، يَكْرَهُ الْـمَوْتَ وَأَنَا أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ.

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন – যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সঙ্গে দুশমনি রাখবে (অর্থাৎ শত্রুতা পোষণ করবে), আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করব। আমি যা কিছু আমার বান্দার উপর ফরয করেছি, তা দ্বারা কেউ আমার নৈকট্য লাভ করবে না (অর্থাৎ, ফরয আমল চাইতেও আমার নিকট অধিক প্রিয় এমন কোন আমল নেই যার মাধ্যমে কোন বান্দাহ্ আমার নিকটবর্তী হতে পারে)। আমার বান্দা সর্বদা নফল ‘ইবাদাত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করতে থাকবে (অর্থাৎ,  এতদ্সত্ত্বেও কোন বান্দাহ্ যদি লাগাতার নফল আমলের মাধ্যমে আমার নিকটবর্তী হয় তখন আমি তাকে ভালোবাসি)। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে (অর্থাৎ, তার কান আল্লাহ্‌র নিয়ন্ত্রণে এসে যায় তাকে ভালবাসার ফলে; তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুই শুনে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই।) । আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে (অর্থাৎ, তার চোখও আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুই দেখে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই)।  আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে (অর্থাৎ,  তার হাতও আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুই ধরে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই)। আমিই তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলে (অর্থাৎ, তার পাও আমার নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। তখন সে তা দিয়ে এমন কিছুর প্রতিই চলে যাতে আমি সন্তুষ্ট হই)। সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই। আমি কোন কাজ করতে চাইলে তা করতে কোন দ্বিধা করি-না, যতটা দ্বিধা করি মু’মিন বান্দার প্রাণ নিতে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি। (সহিহ বুখারী, ৬৫০২)

 

উপরোক্ত হাদিস সূত্রে আরেকটি হাদিস এখানে অবতারণা করতে হয় আপনাদেরকে আরেকটু সুন্দর করে বুঝানোর জন্য, সেটা হলো ‘আয়িয বিন্ ‘আমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা আবূ সুফইয়ান নিজ দলবল নিয়ে সালমান (রাদিয়াল্লাহু আনহু), সুহায়ব (রাদিয়াল্লাহু আনহু) ও বিলাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তখন তাঁরা আবূ সুফইয়ান উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আল্লাহ্ তা‘আলার কসম! আল্লাহ্’র তরবারি এখনো তাঁর এ শত্রুর গর্দান উড়িয়ে দেয়নি। তখন আবূ বকর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমরা কুরাইশ নেতার ব্যাপারে এমন কথা বলতে পারলে?! অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে ঘটনাটি জানানো হলে তিনি বললেন:

يَا أَبَا بَكْرٍ! لَعَلَّكَ أَغْضَبْتَهُمْ، لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ.

‘‘হে আবূ বকর! সম্ভবত তুমি তাদেরকে রাগিয়ে দিলে! যদি তুমি তাদেরকে রাগান্বিত করে থাকো তা হলে যেন তুমি আল্লাহ্ তা‘আলাকে রাগান্বিত করলে’’।

অতঃপর আবূ বকর (রাঃ) তাঁদের নিকট এসে বললেন: হে আমার ভাইয়েরা! আমি তো তোমাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছি। তাঁরা বললেন: না, হে আমাদের শ্রদ্ধেয় ভাই! বরং আমরা আপনার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট দো‘আ করছি তিনি যেন আপনাকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ মুসলিম, ৬৩০৬)

 

[ ব্যাখ্যা ]

এ হাদীসে আল্লাহ তাআলা জানান যে, বান্দা যখন ফরয ইবাদতের পাশাপাশি নফল অমলে রত থাকে, তখন আল্লাহ তাআলা তাকে ভালোবেসে ফেলেন। এভাবে বান্দা আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। আর যখন সে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ওলী হয়ে যায় এবং তিনি তাকে ভালোবেসে ফেলেন, তখন তিনি তার কান, চোখ, হাত ও পায়ে পরিণত হয়ে যান।

এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ তাআলার মানবরূপ ধারণ করা। এমনও নয় যে, তিনি মানুষে পরিণত হয়ে যান; (নাউযুবিল্লাহ)

বরং মানুষ যাতে এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি তাকে সাহায্য করেন। মানুষ বেশিরভাগ গুনাহ এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারাই করে থাকে। মানুষ যখন আল্লাহর ওলী ও বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়, তখন আল্লাহর সাহায্যে গুনাহ থেকে বাঁচতে সক্ষম হয় এবং এসব অঙ্গকে নেক কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পায়।

সে তার কান দিয়ে কোনও অবৈধ ও অহেতুক কথা শোনে না। এমন কথাই শোনে, যাতে আল্লাহ সন্তুষ্ট হন।

সে তার চোখ দিয়ে কোনও অবৈধ বস্তু দেখে না। বরং এমন জিনিস দেখে, যাতে পুণ্য অর্জিত হয়।

সে তার হাত দিয়ে কোনও হারাম বস্তু স্পর্শ করে না; বরং এমন কাজ করে, যাতে আখিরাতের সঞ্চয় হয়।

এবং সে তার পা দিয়ে কোনও অবৈধ পথে চলে না; বরং এমন পথে চলে, যাতে দুনিয়া ও আখিরাতের প্রভৃত কল্যাণ সাধিত হয়।

 

[ শিক্ষণীয় বিষয়াদি ]

……১) হাদীসটিতে খাঁটি বান্দার গুণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে এবং সেই সাথে বলা হয়েছে যার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আল্লাহ্‌র নির্দেশের বাহিরে তিল পরিমাণও অগ্রসর হয় না।

……২) ফরয আমল চাইতেও আমার নিকট অধিক প্রিয় এমন কোন আমল নেই যার মাধ্যমে কোন বান্দাহ্ আমার নিকটবর্তী হতে পারে অর্থাৎ ফরজ তো ফরজই যেটা আপনাকে করতেই হবে। তবে ফরজ কাজের পাশাপাশি যারা লাগাতার নফল নামাজ তথা তাহিয়্যাতুল অযু, তাহিয়্যাতুল মসজিদ, সালাতুল ইশরাক, সালাতুত দ্বোহা, সালাতুত যাওয়াল, সালাতুল আওয়াবিন, প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর অতিরিক্ত দুই রাকাত নফল, কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদ, দুয়া, যিকির ইত্যাদি যখন করতেই থাকে, তখন বান্দা আল্লাহ্‌র ভালোবাসার পাত্র হয়ে যায়।

…….৩) হাদিসটিতে বলা হয়েছে কি করে আল্লাহ্‌র বন্ধু বা ওলি হওয়া যায়। আল্লাহ্‌ তা’আলা বলেনঃ

«أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ، الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَكَانُوْا يَتَّقُـوْنَ، لَـهُمُ الْبُشْرَى فِيْ الْـحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِيْ الْآخِرَةِ، لَا تَبْدِيْلَ لِكَلِمَاتِ اللهِ، ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ»

‘‘জেনে রেখো, (কিয়ামতের দিন) নিশ্চয়ই আল্লাহ্’র ওলীদের কোন ভয় থাকবে না। না থাকবে তাঁদের কোন চিন্তা ও আশঙ্কা। তাঁরা হচ্ছেন খাঁটি ঈমানদার এবং সত্যিকার আল্লাহ্ভীরু। তাঁদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুসংবাদ দুনিয়া এবং আখিরাতেও। আল্লাহ্ তা‘আলার কথায় কোন হেরফের নেই। এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত সফলতা’’। (সূরা ইউনুস, ১০ঃ৬২-৬৪)

    • উক্ত আয়াতে ওলী হওয়ার জন্য খাঁটি ঈমান এবং সত্যিকার আল্লাহ্ভীরুতার শর্ত দেয়া হয়েছে। তথা সকল ফরজ কাজসমূহ পালন করা এবং সকল পাপ-পঙ্কিলতা থেকে দূরে থাকা।
    • কখনো হঠাৎ কোন পাপকর্ম ঘটে গেলে তাওবার মাধ্যমে তা থেকে মুক্তির ব্যবস্থা নেয়া। উপরন্তু নফল আমলসমূহের প্রতি বেশি মনযোগী হওয়া এবং আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কাউকে ভালোবাসা।

……৪) আমাদের কাজ হলো আল্লাহ্‌র জন্য আল্লাহ্‌র বন্ধু তথা ওলিদের ভালাবাসা, কারণ আল্লাহ্‌র জন্যই অন্যের সাথে উঠে বসে; আল্লাহ্‌র জন্য ই অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করে, আল্লাহ্‌র জন্যই কাউকে দান করে। এই কথাটিও হাদিসের মাধ্যমে জানতে যা মু’আয বিন্‌ জাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত…… রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

وَجَبَتْ مَحَبَّتِيْ لِلْمُتَحَابِّيْنَ فِيَّ، وَلِلْمُتَجَالِسِيْنَ فِيَّ، وَلِلْمُتَزَاوِرِيْنَ فِيَّ، وَلِلْمُتَبَاذِلِيْنَ فِيَّ.

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন- আমার কর্তব্য ওদেরকে ভালোবাসা যারা আমার জন্য অন্যকে ভালোবাসে, আমার জন্য অন্যের সাথে উঠে-বসে, আমার জন্য অন্যের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং আমারই জন্য কাউকে দান করে’’। (ইব্নু হিববান/মাওয়ারিদ, হাদীস ২৫১০; বাগাওয়ী ৩৪৬৩, কোযায়ী, হাদীস ১৪৪৯, ১৪৫০)

……৪) হাদিস থেকে এও জানতে পারি, আল্লাহ্‌ তা’আলা মুমিন বান্দার প্রাণ নিতে দ্বিধা করেন। এর কারণ আল্লাহ্‌ স্বয়ং কুরআনে বলছেনঃ “বান্দা মৃত্যুকে অপছন্দ করে আর ওদিকে আল্লাহ্‌ বলেন ওহে প্রশান্তিময় আত্মা! চলে আসো তোমার প্রতিপালকের কাছে সন্তুষ্টি সহকারে এবং সন্তোষের পাত্র হয়ে আমার (সম্মানিত) বান্দাদের মধ্যে প্রবেশ কর আর প্রবেশ কর আমার জান্নাতে- (আল ফজর, ৮৯ঃ২৯-৩০)

 

[ শেষের কথা ]

তবে একটি কথা না বললেই হয় না। আর তা হচ্ছে, আল্লাহ্ তা‘আলার ওলী হওয়ার জন্য এ ব্যাপারে কারোর ইজাযত বা খিলাফত পেতে হবে কি? তার বংশটি কোন ওলীর বংশ হতে হবে কি? ওলী হওয়ার জন্য সুফিবাদের ধরা-বাঁধা নিয়মানুযায়ী রিয়াযত-মুজাহাদা করতে হবে কি? উক্ত পথ পাড়ি দিতে কোন ইযাযতপ্রাপ্ত ওলীর হাত ধরতে হবে কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। না, এর কিছুই করতে হবে না। বরং উপরে উল্লেখিত শর্ত পূরণ করলেই আল্লাহ্‌র খাস বন্ধু তথা ওলি হওয়ার তাওফিক লাভ করবেন। আল্লাহ্‌ আমাদের সকলকে আল্লাহ্‌র ওলি তথা বন্ধু হবার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা যেন করার তাওফিক আল্লাহ্‌ আমাদের সবাই নিজ দয়া ও করুনায় দান করুন। (আমিন)