[ ভূমিকা ]
ইসলাম যে সব হক বা অধিকারের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো- এক মুসলমান ভাইয়ের ওপর অন্য মুসলমান ভাইয়ের হক বা অধিকার। আর এগুলো এমন কতগুলো অধিকার যার প্রত্যেকটি পৃথক পৃথক বিবেচনায় নিলে ইবাদতের দিক থেকে তার কোনটি সুন্নাত, কোনটি ওয়াজিবের পর্যায়ে পড়ে, ফরজের কাতারে নয়। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন ঈমানের ভিত্তিতে নিজেকে মুসলিম দাবী করে তখন তার ঈমানের দাবীই হলো অপর মুসলমানের প্রতি উল্লেখিত কর্তব্যগুলো পালন করা। আবার এগুলো কুরআন বা হাদীস কর্তৃক নির্ধারিত নিকট আত্মীয়দের জন্য কোন অধিকার নয়, বরং এটি আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধনী-গরীব, পরিচিত-অপরিচিত সকল মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের ঈমানের দাবী যে, সে তার অন্য মুসলিম ভাই থেকে কতক অধিকার লাভ করবে। মূলত ইসলাম যেমন রক্তের বা বংশের সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বারোপ করেছে ঈমানে ভিত্তিতে যে বন্ধন তৈরী হয়েছে তার ওপর।
[ হাদিস সমূহ ]
এক। ……… সহিহ বুখারীর রেওয়াতে, আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ ﷺ – কে বলতে শুনেছেনঃ
حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدُّ السَّلاَمِ، وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ، وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ، وَإِجَابَةُ الدَّعْوَةِ، وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ
❝ এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের পাঁচটি অধিকার রয়েছেঃ (১) সালামের জবাব দেয়া; (২) অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেয়া;
(৩) জানাজার পশ্চাদানুসরণ করা; (৪) দা’ওয়াত কবুল করা; (৫) হাঁচিদাতার (হাঁচির) জবাব দেওয়া। ❞ ①
দুই। ……… আবার সহিহ মুসলিমের রেওয়াতে পাওয়া যায়, আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
حَقُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ سِتٌّ ” . قِيلَ مَا هُنَّ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ ” إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ فَسَمِّتْهُ وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتَّبِعْهُ
❝ মুসলিমের প্রতি মুসলিমের হক ছয়টি। প্রশ্ন করা হলো- সেগুলো কী, হে আল্লাহর রাসূল ﷺ ! তিনি ﷺ বললেন, (সেগুলো হলো-)
(১) কারো সাথে তোমার দেখা হলে তাকে সালাম করবে; (২) তোমাকে দা’ওয়াত করলে তা তুমি কবূল করবে; (৩) সে তোমার নিকট ভাল উপদেশ চাইলে,
তুমি তাকে ভাল উপদেশ দিবে; (৪) সে হাঁচি দিয়ে ‘আলহাম্দু লিল্লাহ’ বললে, তার জন্যে তুমি (ইয়ারহামুকাল্লাহ্ বলে) রহ্মাতের দু’আ করবে;
(৫) সে পীড়িত হলে তার সেবা-শুশ্রুষা করবে; এবং (৬) সে মৃত্যুবরণ করলে তার (জানাযার) সাথে যাবে। ❞ ②
তিন। ……… আবার জামে’ আত-তিরমিজী রেওয়াতে পাওয়া যায়, আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ
❝ এক মু’মিনের জন্য আরেক মু’মিনের উপর ছয়টি দায়িত্ব রয়েছেঃ (১) সে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে;
(২) মারা গেলে তার জানাযায় উপস্থিত হবে; (৩) ডাকলে তাতে সাড়া দিবে; (৪) তার সাথে দেখা হলে তাকে সালাম করবে;
(৫) সে হাঁচি দিলে তার জবাব দিবে; এবং (৬) তার অনুপস্থিতিতে কিংবা উপস্থিতিতে সকল অবস্থায় তার শুভ কামনা করবে। ❞ ③
[ ব্যাখ্যা ]
কোনো মানুষের সাথে গড়া ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পর্ক হচ্ছে দ্বীনি ভ্রাতৃত্ব। এ জন্যই শরিয়ত দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের সাথে কিছু বিধান দিয়েছে; যাতে এ ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক মজবুত ও সুদৃঢ় হয়। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সুদৃঢ়কারী সেসব বিধানের মধ্যে কিছু বিধান এ হাদিসে এসেছে। বলা হয়েছে:
১…। সালামের জবাব দেওয়াঃ যদি আপনার ভাই আপনাকে সালাম দেয়, তাহলে অবশ্যই আপনাকে সালামের জবাব দিতে হবে। সালামের আদব হচ্ছে, যে শব্দে সালাম দেওয়া হবে তার চেয়ে উত্তম শব্দে সালামের উত্তর দেওয়া। যদি কেউ আপনাকে সালাম দেয় ❛আস-সালামু ‘আলাইকুম❜ বলে, তাহলে আপনি তাকে জবাব দেবেন, ❛ওয়া ‘আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ…❜ বলে। যদি কেউ ❛আস-সালামু ‘আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ❜ বলে সালাম দেয়, তাহলে আপনার জবাব হবে, ❛ওয়া ‘আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ❜। যদি কেউ সালামের সব শব্দ ব্যবহার করে সালাম দেয়, তাহলে আপনিও অনুরূপ শব্দে সালামের উত্তর দেবেন।
২…। অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেয়াঃ যখন আপনার কোন মুসলিম ভাই অসুস্থ হবে, তখন অবশ্যই সেটাকে গুরুত্বের সাথে নেবেন। আর সে গুরুত্বের বহিঃপ্রকাশে এতটা অন্তত করবেন যে, আপনি তাকে দেখতে যাবে, তার জন্য দুআ করবেন, তাকে কিছু হাদিয়া দেবেন; অথবা সুযোগ থাকে সেবা-শ্বশ্রুষা করবেন। এতে তার অন্তরে কিছুটা শান্তি অনুভব করতে পারে এবং আর এই আচরণের দ্বারা আপনি নেকীও লাভ করবেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা হতে ইনশা আল্লাহ্ আবার আপনার দোয়া কবুল করলে আপনার সেই মুসলিম ভাই রোগ থেকে সেরে উঠতে পারেন ইনশা আল্লাহ্। আর যতক্ষণ আপনি আপনার রুগ্ন মুসলিম ভাইয়ের কাছে থাকবেন তখন ফেরেশতাদের অগণিত দুয়ার আচলে বাধা থাকবেন এবং জান্নাতের ফুল কুরানোর মত সুযোগ পাবেন।
৩…। জানাজার পশ্চাদানুসরণ করাঃ (জানাজার সঙ্গে যাওয়া) যখন আপনার কোনো মুসলিম ভাই মারা যায়, তখন আপনি তার জানাজায় অংশগ্রহণে পিছপা থাকবেন না। বরং তার জানাজায় অংশগ্রহণ করবেন, জানাজার নামাজ আদায় করবেন, তার খাটিয়া বহন করবেন, তাকে দাফন করবেন, তার কবরের পাশে তার জন্য দুআ করবেন বেশি বেশি। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আপনার কোনো ভাইয়ের সাথে আপনার যে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব, তা অন্তত এতটুকু অধিকার রাখে তোমার ওপর। আর আপনি তো জানেন-ই অনুপস্থিত ভাই এর জন্য দুয়া করার অনেক ফায়দা রয়েছে।
৪…। দা’ওয়াত কবুল করাঃ যখন আপনার কোন দ্বীনি ভাই আপনাকে বিয়ের ওয়ালিমা বা এমন কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার দাওয়াত দেয়, তখন অবশ্যই আপনার সাধ্যমতো তার দাওয়াত কবুল করবে। সে তো আপনাকে এ জন্যই দাওয়াত দিয়েছে যে, আপনার উপস্থিতি তাকে আনন্দিত করবে, তার অন্তরে প্রফুল্লতা এনে দেবে, তাই তার দাওয়াত কবুল করতে কার্পণ্য করবেন না।
৫…। হাঁচিদাতার (হাঁচির) জবাব দেওয়াঃ যদি আপনার সামনে কেউ হাঁচি দিয়ে ❛ٱلْحَمْدُ لِلَّٰهِ❜ বলে, তাহলে তার জবাবে আপনি ❛يَرْحَمُكَ اللَّهُ❜ বলে তার জন্য রহমতের দুআ করবেন। আর সেও আপনার এ দুআর জবাবে বলবেঃ ❛يَهْدِيكُمُ اللَّهُ وَيُصْلِحُ بَالَكُمْ❜
৬…। উপদেশ চাইলে ভালো উপদেশ দেওয়াঃ একটু ভাবুন যখন আপনার কাছে কোন মুসলিম ভাই উপদেশ বা নসিহত চাইবে এমন কোন ব্যাপারে যেটা সম্পর্কে অবগত সে ক্ষেত্রে অবশ্যই তার জন্য যেটা উত্তম সেটায় বলবেন। অথবা যদি বিষয়টা আপনার জানা না থাকলে আপনি বিষয়টি আলেম-উলামার কাছে জেনে তাকে বলতে পারেন, কিন্তু খবরদার কোন প্রকার অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিংবা কোন বিনিময় নেওয়ার উদ্দেশ্যে কোন কিছু করবেন না। যদি নিতান্তই অপারগ থাকেন, ক্ষমা চেয়ে নিবেন।
৭…। কল্যান কামনা/দু’আ করাঃ আপনার কোন ভাই জীবিত কিংবা মৃত, অথবা অনুপস্থিত কিংবা উপস্থিত, সর্বক্ষেত্রে তার জন্য দু’আ করে যাওয়া, তার জন্য আল্লাহর নিকট রহমতের আর্জি পেশ করা আপনার কর্তব্য। হাদিসে ত এসেছেই, আপনি যখন কোন অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য কল্যাণ কামনা বা দু’আ করেন, ফেরেশতারাও আপনার জন্য অনুরূপ দু’আ করে আমিন বলেন।
[ শিক্ষণীয় বিষয় ]
১] উল্লেখিত হাদিসগুলোতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কৃত ভ্রাতৃত্বের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে।
২] আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, মুসলিম ভ্রাতৃত্বকে মজবুত ও দৃঢ় করে এমন সব ভালোবাসা বৃদ্ধিকারী কাজ করা, ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে আরও প্রতিষ্ঠিত করা। আর এ হাদিসে তারই কিছু সর্বোত্তম উপায় বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু উপায় আছে, যেমন: মুচকি হাসি, হাদিয়া দেওয়া প্রভৃতি। সেসব বিষয় অন্যান্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
[ করণীয় ]
১] আমাদের এ সকল হক্ব যথাযথ ভাবে আদায়ে সচেষ্ট থাকতে হবে।
২] ছোট বেলা হতেই আমাদের ছেলে-মেয়েদের এই সব শিক্ষা দান করতে হবে।
৩] উদারতার পরিচয় বহন করতে হবে সকল ক্ষেত্রে এই হাদিসগুলো সেই দিক নির্দেশনা দান করে আমাদের।
৪] সকলের মধ্যে এই অধিকারগুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে এবং সেটা বাস্তবে রূপ দিতে হবে অর্থাৎ এর উপর যথাযত আমল করতে হবে।
৫] আজকাল মানুষে মানুষে রেশারেশি। এখনই মোক্ষম সময় মুসলিম ভ্রাতৃত্ব মজবুত করার আর উল্লেখিত হাদিসের আমলের চেয়ে শ্রেষ্ট আর কি উপায় হতে পারে বলুন?
[ শেষের কথা ]
এক মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের আরেকটি হক হলো, তার সম্পর্কে মনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ পুষে না রাখা। কারণ মুমিন হবে পরিষ্কার মনের অধিকারী। তার অন্তর হবে অনাবিল-শুদ্ধ। তার হৃদয় হবে কোমল ও দয়ার্দ্র। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে অপর মুসলিম ভাইয়ের হক বা অধিকারগুলোকে যথাযথভাবে আদায় করার মাধ্যমে ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করার তওফিক দান করুন। আমিন।
① সহিহ বুখারী, ১২৪০ । হাদিসের মানঃ সহিহ
② সহিহ মুসলিম, ৫৫৪৪ । হাদিসের মানঃ সহিহ
➂ জামে’ আত-তিরমিজি, ২০১৬ । হাদিসের মানঃ সহিহ
বইঃ হাদিস পড়ি আদব শিখি
লেখকঃ শাইখ আলী জাবির আল-ফাইফি
প্রকাশকঃ রুহামা পাবলিকেশন