☑ আপনার কাছে একটা স্মার্টফোন আছে। ফোনটি বিক্রি করতে চান। কিন্তু ফোনটিতে অনেক সমস্যা আছে। পাওয়ার বাটন ঠিকমতো কাজ করে না। সমস্যা আছে ভলিউম বাটনেও। সাউন্ড বাড়ানো কমানো যায় না। তা ছাড়া, প্রায়ই ফোন হ্যাং হয়ে যায়। চার্জও থাকে কম।
এখন এটি কীভাবে বিক্রি করবেন? সত্য বলে, নাকি মিথ্যা বলে? সত্য বললে কেউ কিনবে না। মিথ্যা বললে অন্যকে ঠকানো হবে। কী করবেন এখন? ভাবনায় পড়ে গেলেন। এই যে ভাবনাটা, ‘কী করব এখন, কোনদিকে যাব’-এর নাম ঈমান। ঈমান আছে বলেই এমন ভাবনাটা এসেছে।
☑ দোকান থেকে কিছু কিনেছেন। বিল হয়েছে ৪০০ টাকা। আপনি দোকানদারকে একটা ৫০০ টাকার নোট দিলেন। আপনার ফেরত পাওয়ার কথা ছিল ১০০ টাকা। কিন্তু দোকানদার ভেবেছিল, আপনি ১০০০ টাকার নোট দিয়েছেন। বেচারা ভুল করে আপনাকে ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে ফেলল!
এখন আপনি কী করবেন? আনন্দিত মনে চুপচাপ কেটে পড়বেন, নাকি অতিরিক্ত টাকাটা ফেরত দেবেন―এখানেই আসে ঈমানের প্রশ্ন।
☑ আবার এমনও লোক আছে, রাস্তায় ১০ টাকা পড়ে থাকলে ওঠায় না। কিন্তু টাকাভরতি পুরো একটা মানিব্যাগের লোভ সে সামলাতে পারে না। অথবা একটা বাটনফোন পড়ে আছে, সে হয়তো ভ্রুক্ষেপও করল না। কিন্তু একটা স্মার্টফোনের লোভ থেকে সে বাঁচতে পারে না। কিছুক্ষণ এদিক―ওদিক তাকায়। এরপর সুযোগ পেলেই মানিব্যাগটা অথবা স্মার্টফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।
অর্থাৎ ঈমান আছে, কিন্তু এতটাই দুর্বল যে, এই ঈমান নিয়ে তার পক্ষে মূল্যবান কোনো কিছু আত্মসাৎ করার লোভ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দেওইয়া যাক। দোকান থেকে কাপড় কিনে রিকশায় উঠলেন। তিন ব্যাগ কাপড়। তিনটা ব্যাগ একসঙ্গে নিয়ে বসতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই একটা ব্যাগ রাখলেন রিকশার হুডের পেছনটায়। বাকিগুলো সামনেই। গন্তব্যে পৌঁছে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করে বাসায় প্রবেশ করলেন। কিন্তু ততক্ষণে ঘটে গেছে দুর্ঘটনা। সামনের বড় ব্যাগগুলোই শুধু নামিয়েছিলেন, পেছনের ব্যাগটা নামাতে আর মনে ছিল না। রিকশাওয়ালাও লক্ষ করেনি। সে ভাড়া নিয়ে চলে গেছে।
কিছুক্ষণ পর বাসার কলিংবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখি রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাগ যে ফেলে এসেছি, তখনো আমার মাথায় আসেনি। আমি অবাক গলায় বললাম,
– ‘কী ব্যাপার ভাই, কী হয়েছে? ভাড়া কি কম দিয়েছি?’
– ‘না।’
– ‘তাহলে?’
– ‘আপনার একটা ব্যাগ আমার রিকশায় ফেলে এসেছিলেন। সেটা ফেরত দিতে এসেছি।’
ব্যাগ ফেরত পেয়ে এত খুশি হলাম যে, বলার অপেক্ষা রাখে না। খুশি হয়ে কিছু টাকা রিকশাওয়ালাকে উপহার দিলাম। সে চলে যাওয়ার পর ব্যাগটা খুললাম। খুলেই বিস্মিত হতে হলো। ব্যাগের ভেতর থেকে একটা জামা গায়েব! আমার স্পষ্টই মনে আছে, চারটা জামা ছিল। কিন্তু এখন আছে তিনটা। তার মানে, জামাটা রিকশাওয়ালাই রেখে দিয়েছে। সে হয়তো ভেবেছে, ফেরত তো দিচ্ছিই। একটা রেখে দিলে আর কী এমন ক্ষতি হবে! তিনটা যে দিচ্ছি, এ-ই তো বেশি!
অর্থাৎ কারও কারও ঈমান কখনো কখনো ছোটখাটো গুনাহ থেকে তো তাকে বিরত রাখে, কিন্তু বড় গুনাহ থেকে বাঁচাতে পারে না।
‘নামাজ না পড়লে কী হবে, ঈমান ঠিক আছে‘- বলা মানুষগুলোর ঈমান আছে সবচেয়ে অসুস্থ অবস্থায়। একেবারে বিকলাঙ্গ রোগীর মতো। ‘পর্দা না করলে কী হবে, ঈমান ঠিক আছে। রোজা না রাখলে কী হবে, ঈমান ঠিক আছে। হজে না গেলে কী হবে? সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে ব্যবসা করলে কী হবে-আমাদের ঈমান তো ঠিক আছে!‘
অদ্ভুত কথা!
ধরুন, আপনি আজকে চমৎকার একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিলেন। নামি কোনো ব্রান্ডের আউটলেট থেকে অনেক দাম দিয়ে কিনে আপনাকে কেউ গিফট করেছে। সারা দিন পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে আনন্দিত মনে ঘোরাঘুরি করলেন। পাঞ্জাবি দেখে সবাই অনেক প্রশংসা করল। প্রশংসা শুনে আহ্লাদে আপনি আট-আট ‘ষোলোখানা’ হয়ে গেলেন। দারুণ একটা দিন পার হলো। রাতের বেলা বাসায় এসে পাঞ্জাবিটা খুলে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রেখে ঘুমাতে গেলেন।
ঝামেলা বাধল সকালেই। ঘুম থেকে উঠে দেখেন পাঞ্জাবির একটা হাতা নেই! কোথায় গেল হাতা?
তদন্তে ধরা পড়ল আসল ঘটনা। হাতাটা ইঁদুরের পেটে চালান হয়ে গেছে। কে জানে, বেচারা হয়তো পাউরুটি কিংবা পিৎজা ভেবে কুচিকুচি করে চেটেপুটে খেয়ে নিয়েছে! আপনি কি এখন বলবেন, ‘হাতা গেছে তো কী হয়েছে? আমার পাঞ্জাবি তো ঠিক আছে!‘
পরদিন দেখেন অন্য হাতাটিও নেই। এর পরদিন পিঠের একাংশও নেই। চলে গেছে ইঁদুরের পেটে। তবুও কি বলবেন, ‘পিঠের অংশ আর হাতাই তো গেছে! পাঞ্জাবি তো ঠিক আছে!‘
ঠিকই যদি থাকে, যান তো দেখি এই পাঞ্জাবি পরে বন্ধুর বিয়েতে! যান না দূরের কোনো ট্যুরে! যেতে কি পারবেন কাছেরই কোনো বাজারে? কেন পারবেন না? দামি পাঞ্জাবিই তো ছিল! প্রিয়জনই তো গিফট করেছে! তবুও কেন পারছেন না? কারণ এটা এখন আর পাঞ্জাবির পর্যায়ে নেই। এটা হয়ে গেছে কোনো দেশের ‘মানচিত্র’ অথবা পাতিল মোছার ‘ন্যাকড়া’।
ঈমান আছে, নামাজের খবর নেই। ঈমান আছে, জাকাত দেই না। ঈমান আছে, হালাল-হারামের পরোয়া নেই। টুপি নেই। দাড়ি নেই। কাপড়টা টাখনুর ওপরে উঠানো নেই। আমল-আখলাকের বালাই নেই… ভালোভাবে চিন্তা করে দেখুন তো, এই বিকল হয়ে যাওয়া ঈমানে তাহলে আছেটা কী?
এ তো হচ্ছে ওই মুদি দোকানটার মতো, যেখানে সাইনবোর্ড আছে মাল নেই। অথচ সাইনবোর্ডে লেখা-এখানে সকল ধরনের মুদি ও মনোহারি মালামাল পাওয়া যায়-অথচ ভেতরটা খালি।
– কাস্টমার এসে জানতে চাইছে, ‘চাল আছে?’
– ‘নেই।’
– ‘ডাল আছে?’
– ‘নেই।’
– ‘লবণ, পেঁয়াজ, মশলা?’
– ‘জি না, নেই। অন্যকিছু লাগবে?’
আরে ভাই, যা থাকার কথা তা-ই তো নেই, অন্যকিছুর কথা জানতে চেয়ে লাভ কী?
যতই মাল-মশলাহীন হোক, নিজ দাবিতে অটল-এমন লোকও আছে বিস্তর! সর্বদা আল্লাহর হুকুমকে পাশ কাটিয়ে চলা কোনো লোককে যদি বলা হয়, ‘মিয়া আপনি তো একটা বেইমান!‘ সে খেপে যাবে। কিছুতেই মেনে নিতে চাইবে না। প্রয়োজনে আপনাকে একহাত দেখে নেবে। এমনকি মেরে আপনার নাকমুখ ফাটিয়েও দিতে পারে! তবুও ‘বেইমান‘ শব্দটি সে নিজের জন্য কিছুতেই সহ্য করবে না।
অথচ সে পর্দা নিয়ে কটাক্ষ করে। দাড়ি-টুপির কথা শুনলেই নাক সিটকায়। কুরআনের কোনো আয়াত তার চিন্তা-চেতনা আর মতাদর্শের বিপক্ষে গেলে চেঁচিয়ে মাঠ গরম করে। মুখে বলে ‘রাসুলকে ভালোবাসি’, অথচ রাসুলের আদর্শ মেনে চলা লোকদেরকে ছোট নজরে দেখে। গালাগালি করে। বিরুদ্ধে লেগে থাকে। তো, এই ঈমান তার জন্য দুনিয়াতেই-বা কী উপকারে এলো, ওপারেই-বা কী কাজে আসবে?
ঈমানের সঙ্গে পরিশুদ্ধ আমলও ‘যোগ’ হওয়া চাই। ঈমান আছে আমল নাই; কাজ হবে না।
ঈমান হচ্ছে ‘এক’ সংখ্যাটির মতো। ‘এক’ এর ডানে যত বেশি সংখ্যা বসবে ততই তার মান বাড়বে। একের ডানে একটি শূন্য বসলে, ১০। আরেকটি বসলে, ১০০। এভাবে ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লাখ। কিন্তু বামে যদি কয়েক ট্রিলিয়ন সংখ্যাও বসান, লাভ হবে??
কোনো লাভ নেই।
‘বামপন্থি’ হওয়া মানে তো বঞ্চিত হয়ে খালি হাতে ওপারে যাওয়া। নিজের ‘কু’-মতাদর্শ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ‘বুদ্ধিজীবী’ উপাধি পাওয়া কত বামপন্থি যে অন্ধকার কবরে নিঃস্ব হয়ে পড়ে আছে; সেই হিসাব কে রাখে! অতএব, ঈমান ছেড়ে বামপন্থি হবেন, নাকি ঈমান নিয়ে ডানপন্থায় যাবেন; তা এখন আপনাকেই নির্ধারণ করতে হবে।
সংগৃহীত ও ঈষৎ পরিমার্জিত,
বইঃ কাল থেকে ভালো হয়ে যাবো
লেখকঃ মাহিন মাহমুদ