সমসাময়িক ইসলামিক জীবন – ১
( কাল থেকে ভালো হয়ে যাব )
শয়তান আমাদের একটা বিপজ্জনক ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখেছে। এ ধোঁকার নাম- ❛ কাল থেকে ভালো হয়ে যাব ❜।
যদি বলা হয়-
………..: ভাই, কাজটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। মসজিদে আজান হচ্ছে, অথচ আপনি ফেসবুক নিয়ে বসে আছেন? চলেন না ভাই মসজিদে।
………..: হুজুর, আপনি যান আমার কাপড়চোপড় ঠিক নাই।
………..: এটা কোনো সমস্যা না। চলেন, বাসা থেকে পাক-পবিত্র কাপড় পরে নেবেন!
………..: না, ইয়ে মানে… আজকে না। দোয়া কইরেন। কাল থেকে ভালো হয়ে যাব। সব ছেড়েছুড়ে মসজিদেই পড়ে থাকব।
যদি বলা হয়-
………..: ভাই, মিথ্যা বলে ব্যবসা করা ঠিক না। মিথ্যা বলা মহাপাপ!
………..: কী করব বলেন? সত্য বললে তো লাভ বেশি করা যায় না। তাই একটু-আধটু মিথ্যা বলে নিচ্ছি। তবে কথা দিচ্ছি, কাল থেকে ভালো হয়ে যাব। এইসব ধোঁকাবাজি আর করব না।
যদি বলা হয়-
………..: ও ভাই, এবার থামেন না। সুদ-ঘুষের ইনকাম আর কত? হালাল পথে চলেন না!
………..: হুজুর, দোয়া কইরেন। পাঁচতলাটা মাত্রই কমপ্লিট হলো। সামনের মাসে আরেকটা প্লট বুকিং দিতেছি। এরপর থেকেই!… সত্যি বলছি এরপর থেকে আমাকে আর এই লাইনে পাবেন না। একদম ভালো হয়ে যাব, দেইখেন!
কখনো কখনো নিজের বিবেককেই নিজে ধোঁকা দিতে থাকি-
- ইউটিউবে হারাম জিনিস আর দেখব না।
- কাল থেকে আর একবারও পর্ন সাইটে ঢুকব না।
- ফেসবুকে আর মেয়েদের সঙ্গে চ্যাটিং করব না।
- বেগানা মেয়েদের ছবি পেলেই জুম করে তাকিয়ে থাকব না। তাদের নিয়ে খারাপ কল্পনা করব না। তাদেরকে ‘ইমপ্রেস’ করার জন্য গল্প-কবিতা লিখব না। তাদের একটু সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় বইমেলায় ঘুরঘুর করব না।
- অযথা কোনো মেয়েকে ইনবক্সে বিরক্ত করব না। তাদের দুর্বলতাকে অসহায়ত্ব ভেবে ‘সুযোগ’ নেব না। হারাম রিলেশনে জড়াব না। যেটাতে জড়িয়েছি সেটাতেও আর কয়েক দিনই শুধু। এরপর ব্রেকাপ করে দিয়ে একদম ভালো হয়ে যাব, আর জীবনেও ওই পথ মাড়াব না।
প্রতিদিনই এসব বলছি। অথচ পরদিনই সব ভুলে যাচ্ছি।
বাচ্চারা চকলেটের জন্য কান্নাকাটি করে। ৫০০ টাকার নোট দিলেও সেই কান্না থামে না। চকলেটই তার চাই। কারণ, সে ৫০০ টাকার মূল্য বোঝে না। অথচ একটা ৫০০ টাকা দিয়ে কত কত চকলেটই না সে কিনতে পারত!
আমরাও যেন আজ দুনিয়ার সামান্য ❛চকলেট❜ এর জন্য আখেরাতের সুবিশাল নেয়ামত হাতছাড়া করতে রীতিমতো কান্না জুড়ে দিয়েছি।
কবরের আজাব থেকে মুক্তি? চাই না।
হাশরের ময়দানে আরশের ছায়া? চাই না।
পুলসিরাতের পথ সহজ হওয়া? চাই না।
বিনা হিসাবে জান্নাত? চাই না।
মহামহীয়ান আল্লাহর দিদার? চাই না।
যত যা-ই বলুন, একমাত্র দুনিয়াই আমার চাই! সব ভেসে যাক। গোল্লায় যাক আখেরাত।
- তবুও দোকান ছেড়ে জোহরে যাওয়া-চলবে না।
- ঘুম ছেড়ে ফজরে যাওয়া-ইম্পসিবল!
- বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে আছর-মাগরিব-হতেই পারে না!
- সারা দিন কাজ করেছি-রাত হয়েছে-এখন ঘুমোতে হবে-এশা পড়া তো সম্ভবই না!
দুনিয়ার যৎসামান্য ‘চকলেট’ পাওয়ার আনন্দ আমাকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে। একেবারে বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছি। যতই বোঝানো হোক-
দুনিয়ার সবকিছু শুধুই ❛নমুনা❜। আখেরাতে আছে ❛খাজানা❜; আমরা বুঝতেই চাচ্ছি না! দুনিয়ার সামান্য ‘নমুনা’র প্রেমে পাগল হয়ে যাচ্ছি। লোভে চকচক করছে চোখ! নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছি কামনার আগুনে। উঠতি বয়সি তরুণ বলেন, অথবা থুথুরে বুড়ো! কেউ থেমে নেই।
সুন্দরী একটা মেয়ে একটু হেসে কথা বলেছে কিংবা চোখ তুলে তাকিয়েছে! অথবা, ফেসবুকে-মেসেঞ্জারে নক করেছে। ব্যস, সেই মেয়ের প্রেমে যেন পড়তেই হবে। আসল না নকল, যাচাই করারও সময় নেই।
প্রিয় মুহতারাম ভাই আমার, নমুনাকে ছাড়ুন! যার হাতে পুরো খাজানা, তাঁর প্রেমে পড়ুন!
বাদশাহর সেই কালো বাঁদিটির কথা কি ভুলে গেছেন। যাকে কিনা বাদশাহ খুব বেশি পছন্দ করতেন। অথচ সুন্দরী-সুশ্রী, আনত নয়না অন্যান্য অনেক বাঁদি ছিল। তাদের দিকে বাদশাহর তেমন গুরুত্বই ছিল না।
আমাদের সুন্দরী বোনেরা তো ভেবেই নিয়েছেন-ছেলেরা তাদের দিকে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকবে। না তাকালে তারা অপমানিত হন। বোনেরা বুঝতেই চান না; আল্লাহভীরু যুবকদের কাছে রূপের চেয়ে গুণের কদরই বেশি!
বাদশাহর সুন্দরী বাঁদিরাও অপমানিত হতো। তাদের গা জ্বলে যেত। একদিন তো বলেই বসল-‘আচ্ছা মহামান্য বাদশাহ, একটা কথা জানতে পারি?’
‘অবশ্যই পারো।’
‘আমরা এত রূপবতী বাঁদি আপনার। অথচ…!’
কথা শেষ করার আগেই বাদশাহ ওদের থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমি বুঝতে পেরেছি তোমরা কী বলতে চাও। কালোটাকে কেন এত পছন্দ করি, এই তো?’
‘জি, মহারাজ!’
‘এই প্রশ্নের উত্তর পাবে আগামীকাল। সকালবেলা আমার ধনভান্ডার কিছু সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এই সময় হিরা, জহরত, মণিমুক্তা যে যেটা ধরবে সেটাই তার হয়ে যাবে।’
সকাল হলো। খুলে দেওয়া হলো ধনভান্ডারের দরজা। সুন্দরী বাঁদিরা ছুটে গিয়ে দামি দামি সোনার হার, হিরা খচিত অলংকার-যে যেটা পারল নিয়ে নিলো। শুধু একজন, সেই কালো বাঁদিটা, সে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল বাদশাহর সিংহাসনের পেছনে।
সুন্দরীরা হাসতে লাগল তার এই বোকামি দেখে। ঠোঁট উলটে ব্যঙ্গ করে বলতে লাগল, ‘এই বোকার হদ্দটাকে বাদশাহ এত পছন্দ করেন কেন কে জানে! বোকাটা এত সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও হিরা-জহরতের কিছুই নিলো না!’
বাদশাহ তো সবই জানেন, তারপরও কালো বাঁদিটিকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি ঘোষণাটি শোনোনি?’
‘জি, শুনেছি।’
‘তাহলে? কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছ? মণিমুক্তা, সোনা-গহনা নিচ্ছ না কেন? জানোই তো, যে যেটা ধরবে সেটাই তার হয়ে যাবে!’
‘বাদশাহ নামদার, আমি তো ধরেছিই।’
‘কী?’
‘সিংহাসনে বসা বাদশাহকে। স্বয়ং বাদশাহই যদি আমার হয়ে যায়, আমার কি আর কিছু ধরার প্রয়োজন আছে?’
কালো বাঁদির কথা শুনে ‘ধলাগুলো’ হাঁ হয়ে গেল।
কালো একটা বাঁদি, দেখতে সুন্দর না অথচ কতটা বিচক্ষণ! বুঝতে পেরেছিল ‘খাজানা’র মূল্য। আমরাই শুধু বুঝলাম না। অথবা বুঝি, কিন্তু বুঝটাকে কাজে লাগাতে লাগাতে সবকিছু হারিয়ে বসতে যাচ্ছি, নিচের গল্পের এই অফিসারটির মতো-
এক অফিসার তার সব কাজ চাকরবাকর দিয়ে করাতেন। যত অল্প কাজই হোক, নিজে করতে চাইতেন না। একদিন সকালবেলা। মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছেন। উঠেই দেখেন তার ঘরে বানর ঢুকেছে। ঢুকেই ক্ষান্ত হয়নি, জিনিসপত্র লুটপাট শুরু করে দিয়েছে।
এক বানর স্যুট নিয়ে চলে যাচ্ছে তো আরেক বানর রওনা হচ্ছে পাজামা নিয়ে।… মাথার হ্যাট নিয়ে ভেগে যাচ্ছে এক বানর তো পায়ের জুতা নিয়ে হাওয়া হচ্ছে অন্য আরেকটি। ভদ্রলোক বিছানায় শুয়ে শুয়েই চিৎকার করছিলেন, ‘এখানে কি কোনো মানুষজন নেই? বানরগুলো তাড়িয়ে দিতে পারে না!’
চেঁচামেচি শুনে ভদ্রলোকের এক বন্ধু ছুটে এসে বললেন, ‘মানুষ মানুষ বলে এত চেঁচাচ্ছ কেন, তুমি কি মানুষ নও? তুমিও তো তাড়াতে পারতে। এত অলস হলে কি চলবে?’
বন্ধুর কথা শুনে ভদ্রলোকের সংবিৎ ফিরে এলো। দৌড়ে গেলেন বানর তাড়াতে। ততক্ষণে বেচারার জামা-পাজামা নিয়ে বানরগুলো ভেগে গেছে।
❛কাল থেকে ভালো হয়ে যাব❜ বলে এই যে অলসতায় ডুবে আছি! না জানি মৃত্যুর আগমুহূর্তে শয়তান আমার ঈমান নিয়ে ভেগে যায় কি না। প্রিয় মুহতারাম! জামা-কাপড় চুরি হলে তো নতুন করে কেনা যায়। ঈমান চুরি হয়ে গেলে পরিস্থিতি কী হবে একবারও কি চিন্তা করেছি?
[ শিক্ষণীয় বিষয় ]
- ❛কাল থেকে ভাল হয়ে যাবো❜ – এই কথাটা নিজ থেকেই জানান দেয় আমাদের অনাগ্রহতার। কারণ সে কাল আর কখনো আসে না।
- দুনিয়া-দুনিয়া করে আমরা আখেরাতের সব কিছু হারিয়ে ফেলছি অথচ আখেরাতটা মূখ্য হওয়া উচিৎ ছিল আমাদের।
- আমাদের বোধশক্তি দুনিয়ার রঙ্গিন ফানুসে আটকে গেছে, আর সেটা আমরা শয়তানকে সুযোগ দিয়েছি যেন আখেরাত নিয়ে যেন মাথা ঘামাতে না হয়।
- আল্লাহভীতি যার মধ্যে একবার জাগ্রত হয়েছে, সেটা কেউ সহজে নিভাতে পারে না। তারা আখেরাতের চিন্তায় সদা প্রস্তুত থাকে।
- আসলেই দুনিয়াতে যা কিছু আছে সব-ই এক একটা নমুনা। একটার থেকে একটা বিশাল ভেল্কি যার রচয়িতা শয়তান এবং আমরাও।
- আরশের মালিক যে এক মাত্র আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তা শুধু অন্তরেই গেঁথে আরে পুঁতে রেখেছি। অথচ কাজে-কর্মে এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
- সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা নিজেদেরকে এতটা অলস বানিয়ে ফেলেছি যে শয়তান মৃত্যুর পূর্বেই আমাদের ঈমান হারা করে পালাবে, কিন্তু আমরা সেই ঈমান আর রক্ষা করতে পারব না শত চেষ্টাও।
[ করণীয় ]
- কাল থেকে নয়, আজ এখনই যা শুরু করার করতে হবে খাটি ইখলাসের সহিত।
- অন্তরে আল্লাহভীতি জাগ্রত করতে হবে।
- সমস্ত অনর্থক, বেহায়ামূলক কাজ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরাতেই হবে যে কোন মূল্যে এখনই। কালকের জন্য রেখে দিলে শয়তান আবার পায়তারা করে আপনাকে ফাঁদে জড়িয়ে ফেলবে।
- এমন কোন কাজে নিজেকে এত ব্যস্ত রাখব না যেখানে কেবল দুনিয়া মূখ্য হয়ে উঠে। সকল ক্ষেত্রে আখেরাতের ফায়দা তালাশ করে যেতে হবে।
- খাজানার মালিক স্বয়ং আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা❛আলা। সুতরাং আমাদের আল্লাহ্র কুরআন এবং রাসূলের সুন্নাহের দড়ি আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে, তবে আসল সফলতা।
- দুনিয়ার খাজানা সামান্য, যার মূল্য আল্লাহ্র নিকট একদম নেয়। অথচ আখেরাতে আপনার জন্য জান্নাত অপেক্ষমান, সে জন্য আপনাকে আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সরল পথকে বেছে নিতে হবে।
- অলসতা ছেঁড়ে এখন আখিরাতের জন্য এখনই পরিশ্রম করা শুরু করুন নচেৎ ঈমান ও হারাবেন এবং জান্নাত ও হারাবেন।
বইঃ কাল থেকে ভালো হয়ে যাবো
লেখকঃ মাহিন মাহমুদ
প্রকাশকঃ মাকতাবাতুল হাসান