অধিকার আদায়ের আদব সিরিজঃ মায়ের প্রতি সদাচরণ করা

[ প্রারম্ভিক কথা ]

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু দুনিয়াতে তিনি আমাদের একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় পাঠিয়েছেন। রুহের জগৎ থেকে দুনিয়ার জগতে আসার মাধ্যমে বানিয়েছেন মা-বাবাকে। এ কারণেই মহান আল্লাহ তাঁদের বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। বাবা-মার অধিকার হলো তাদের সঙ্গে সদাচারণ করা এবং তাদের পরিপূর্ণ দেখাশুনা করা।  আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের ১৭ নম্বর সূরা আল-ইসরার ২৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেনঃ

وَقَضٰى رَبُّكَ اَلَّا تَعۡبُدُوۡۤا اِلَّاۤ اِيَّاهُ وَبِالۡوَالِدَيۡنِ اِحۡسَانًا​

আর আপনার রব আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে ও মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। ❞ ①

 

[ হাদিস ]

আবূ হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ

جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللَّهِ، مَنْ أَحَقُّ النَّاسِ بِحُسْنِ صَحَابَتِي؟ قَالَ: ‏« أُمُّكَ »‏ ‏ قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ‏«‏ ثُمَّ أُمُّكَ » ‏‏
« قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ‏«‏ ثُمَّ أُمُّكَ » قَالَ: ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ: ‏«‏ ثُمَّ أَبُوكَ

❝ এক লোক রাসূলুল্লাহ ﷺ  এর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলঃ হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমার নিকট কে উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিক হকদার? তিনি বললেনঃ তোমার মা।
লোকটি বললোঃ অতঃপর কে? রাসূল ﷺ বললেনঃ তোমার মা।
সে বললোঃ অতঃপর কে? রাসূল ﷺ বললেনঃ তোমার মা।
সে বললোঃ অতঃপর কে? তিনি বললেনঃ অতঃপর তোমার বাবা। ❞ ②

 

[ ব্যাখ্যা ]

আমার-আপনার উপর আমাদের মা-বাবার অনেক অনুগ্রহ, অনেক অবদান রয়েছে। তারাই আমাদের এ পৃথিবীতে অস্তিত্বে আসার মাধ্যম। আমাদের সুস্থতা, আমাদের খাবার,  আমাদের পোশাক, আমাদের পড়ালেখা, এক কথায় আমাদের সবদিক তারা দুজনই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাই ইসলাম আমাদের নিকট তাদের স্থানকে মর্যাদাময় করেছেন। তাই তাদের অবাধ্য হওয়া জায়িজ নেই, তাদের কোন কথা ফেলা যাবে না, এমনকি তাদের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকানোও জায়িজ নেই, তাদের উপস্থিতিতে স্বর উঁচু করা যাবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন পবিত্র কুরআনের ১৭ নম্বর সূরা আল-ইসরার ২৩ নম্বর আয়াতেঃ

 اِمَّا يَـبۡلُغَنَّ عِنۡدَكَ الۡكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوۡ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّلَا تَنۡهَرۡهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوۡلًا كَرِيۡمًا‏

তারা একজন বা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ শব্দটি বলো না (অর্থাৎ বিরক্তিসূচক অথবা অবজ্ঞাসূচক কোন কথা) এবং তাদের ভর্ৎসনা  করো না (অর্থাৎ, ধমক দিয়ো না) ; তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারপূর্ণ (অর্থাৎ, সম্মানসূচক) কথা বলো। ❞ ③

 

তাই সব সময় মা-বাবার সর্বোচ্চ সেবা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের। কারণ, তারা দুজনই হচ্ছেন আমাদের জান্নাতের দরজা। বিশেষ করে মায়ের প্রতি বেশি সহানুভূতি দেখাতে হবে এবং বাবাকে বেশি সম্মান করতে হবে। তাদের দুজনকে সব সময় সম্মানের উঁচু স্থানে রাখতে হবে।

 

[ শিক্ষণীয় বিষয় ]

১। বাবা-মার অধিকার হলো তাদের সঙ্গে সদাচারণ ও তাদের পরিপূর্ণ দেখাশুনা করা। তবে মায়ের হক বাবার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। যেহেতু হাদিসে মায়ের হক পরিপূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে তিনবার সাব্যস্ত করার পরেই বাবার হকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

২। মায়ের দুর্বলতা, অধিক মমতা ও সহানুভূতির কারণে বাবার ওপর মায়ের বিশেষত্ব রয়েছে। তাই এ দিকটা বেশি খেয়াল রাখতে হবে। তবে এ কারণে কোনোভাবেই বাবার আনুগত্যে, তার প্রতি সদাচরণে ও তাকে সম্মান করার মাঝে কমতি করা যাবে না।

৩। মহান আল্লাহর ইবাদত করা যেমন প্রতিটি মানুষের জন্য ফরজ, তেমনি মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করাও ফরজ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের মা-বাবার কাছে এতটা ঋণী করেছেন যে পৃথিবীর সব কিছু দিয়ে হলেও আমরা কোন সন্তানই আমাদের মা-বাবার ঋণ শোধ করতে পারবে না। এ কারণে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁদের শুকরিয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনের ৩১ নম্বর সূরা লোকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্‌ আমাদের জানাচ্ছেন এবং আদেশ দিচ্ছেনঃ

وَوَصَّيۡنَا الۡاِنۡسٰنَ بِوَالِدَيۡهِ​ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰى وَهۡنٍ وَّفِصٰلُهٗ فِىۡ عَامَيۡنِ اَنِ اشۡكُرۡ لِىۡ وَلِـوَالِدَيۡكَؕ

আমি তো মানুষকে তার মাতাপিতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে
এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার মাতাপিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। ❞ ④

৪। মা-বাবা যদি অমুসলিমও হয়, তবু তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে। তাদের আদর-আপ্যায়ন করতে হবে। তাদের সাথে অশ্লীল, অশালীন ও অভদ্র ভাষা ও ব্যবহার করা যাবে কখনো। সব ধরনের কষ্টদায়ক ভাষা পরিহার করা। তাদের সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলা। তাদের প্রতি বিনয়ের ডানা নত করা। তাদের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করা।

আসমা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত… তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার আম্মা এসেছেন। তবে তিনি আমাদের দ্বীনের অনুসারী হতে আগ্রহী নন বা ইসলাম গ্রহণে বিমুখ, এখন আমি কি তার সাথে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ।

৫। যদি আমাদের পিতা-মাতা এমন কাজ করতে আদেশ করেন, যা করলে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করতে হয় বা কুফরি করতে হয়, অথবা শরীয়ত বিরোধী, তবে সেই কাজ করার অবকাশ নেই। মহান আল্লাহ স্পষ্ট ভাষায় বলছেন কুরআনের ২৯ নম্বর সূরা আল-আনকাবুত এর ৮ নম্বর আয়াতে

وَوَصَّيۡنَا الۡاِنۡسَانَ بِوَالِدَيۡهِ حُسۡنًا​ ؕ وَاِنۡ جَاهَدٰكَ لِتُشۡرِكَ بِىۡ مَا لَـيۡسَ لَـكَ بِهٖ عِلۡمٌ فَلَا تُطِعۡهُمَا

❝ আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার মাতা-পিতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে; কিন্তু তারা যদি তোমার উপর বল প্রয়োগ করে,
আমার সাথে এমন কিছু শরীক করতে যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই তাহলে তুমি তাদেরকে মান্য করো না। ❞ ⑥

 

[ করণীয় ]

মূলত আমরা যা কিছুই করি না কেন, কোন ভাবেই আমরা আমাদের মাতা-পিতার ঋণ কোনভাবেই শোধরাতে পারব না। সুতরাং আমাদের সকলের উচিত, আমাদের পিতা-মাতা উভয়ের সঙ্গে সব ধরণের অশ্লীল, অশালীন ও অভদ্র ভাষা ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকা। সব ধরনের কষ্টদায়ক ভাষা পরিহার করা।

তাদের সঙ্গে নম্র ভাষায় কথা বলা। তাদের প্রতি বিনয়ের ডানা নত করা। তাদের খেদমতে নিজেকে নিয়োজিত করা। আপনার অন্তর থেকে মনে প্রাণে তাদের জন্য সর্বদা দোয়ায় নিজের জিহ্বাকে ভিজিয়ে রাখা। বেশি বেশি এ দোয়া করা-

رَّبِّ ارۡحَمۡهُمَا کَمَا رَبَّیٰنِیۡ صَغِیۡرًا

হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর যেমনভাবে তারা আমাকে শৈশবে লালন পালন করেছেন। ❞ ⑦

[ শেষের কথা ]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে বাবা-মায়ের প্রতি যত্ন ও খেদমতে নিয়োজিত থাকার তাওফিক দান করুন। বাবা-মায়ের মর্যাদা বোঝার তাওফিক দান করুন। আমাদের সকল দুয়ার মাঝে উনাদের শামিল এবং উনাদের দুয়ার মাঝে আমরা শামিল হতে পারি তার তাওফিক দান করুন। (আমিন)

 


সূরা আল-ইসরা (১৭ঃ২৩)
সহিহুল বুখারী, ৫৯৭১সহিহুল মুসলিম, ৬৩৯৪ । হাদিসের মানঃ সহিহ
সূরা আল-ইসরা (১৭ঃ২৩)
④ সূরা লোকমান, (৩১ঃ১৪)
সহিহ মুসলিম, ২২১৪ । হাদিসের মানঃ সহিহ
⑥ সূরা আল-আনকাবুত (২৯ঃ৮)
সূরা আল-ইসরা (১৭ঃ২৪)


বইঃ হাদিস পড়ি আদব শিখি
লেখকঃ শাইখ আলী জাবির আল-ফাইফি
প্রকাশকঃ রুহামা পাবলিকেশন