[ সংজ্ঞা ]
আচ্ছা বলুন তো, কোন ব্যক্তি দুপক্ষের ঝগড়া বাধানোর জন্য একজনের কথা অন্যজনের কাছে বর্ণনা করে, তাকে কি বলে? সে হলো চোগলখোর। আর এ চোগলখোরী করার ফলে মানুষের মাঝে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি ও সম্পর্কের অবনতি ঘটে, সম্পর্কে ফাটল ধরে এবং তাদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতার বহ্নিশিখা জ্বলে ওঠে। এ এমন এক জঘন্যতম হারাম যা কবিরা গুনাহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
[ কুরআনে কি বলা হয়েছে ]
চোগলখুরীর নিন্দায় আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের ৬৮ নম্বর সূরা আল- ক্বলাম এর আয়াত ১০-১১ নম্বরে উল্লেখ করেন,
وَلَا تُطِعۡ كُلَّ حَلَّافٖ مَّهِينٍ ٠ هَمَّازٖ مَّشَّآءِۢ بِنَمِيمٖ
❛ আর তুমি আনুগত্য করো না প্রত্যেক এমন ব্যক্তির যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছিত। যে পশ্চাতে নিন্দা করে, একের কথা অন্যের নিকটে লাগায়। ❜ (1)
আবার কুরআনের ১০৪ নম্বর সূরা আল-হুমাযাহ এর ১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন আবার,
وَيۡلٌ لِّـكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةِ
❛ দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে (সামনাসামনি) মানুষের নিন্দা করে আর (অসাক্ষাতে) দুর্নাম করে; ❜ (2)
[ হাদিস ]
হুজাইফা বিন ইয়ামান (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত, … রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছেনঃ
لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَتَّاتٌ
❛ চোগলখোর কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। ❜ (3)
[ ব্যাখ্যা ]
ভীষণ ভয়াবহ একটা বিষয় সম্পর্কে নবিজি ﷺ আমাদের জানিয়েছেন যে, এক লোকের জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যায়।
আমরা কি বলতে পারি সে লোক কে?
সে হচ্ছে চোগলখোর! যাকে আরবীতে ক্বত্তাত বা নাম্মাম হিসেবে পরিচিত। যে কাউকে কথা বলতে শুনলে কান পেতে তার কথা শুনে, যতটুকু ভেজাল লাগানোর জন্য দরকার ততটুকু শুনে তার বন্ধু বা ভাই বা আত্মীয়ের কাছে গিয়ে উগরে দেয়। এভাবে চোগলখোর সমাজে শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রসার করতে থাকে।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মদীনার একটি খেজুর বাগান দিয়ে যাচ্ছিলেন, তথায় তিনি দু’জন লোকের আহাজারী শুনতে পেলেন। তখন তাদেরকে কবরে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«إِنَّهُمَا لَيُعَذَّبَانِ، وَمَا يُعَذَّبَانِ فِي كَبِيرٍ، أَمَّا أَحَدُهُمَا فَكَانَ لاَ يَسْتَتِرُ مِنَ البَوْلِ، وَأَمَّا الآخَرُ فَكَانَ يَمْشِي بِالنَّمِيمَةِ»
❛ এ দু’জনকে ‘আযাব দেওয়া হচ্ছে। তবে বড় কোনো কারণে নয়। অবশ্য এগুলো কবীরা গুনাহ।
তাদের একজন পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করত না। অন্যজন চোগলখুরী করে বেড়াত। ❜ (4)
চোগলখুরীর একটি নিকৃষ্ট প্রক্রিয়া হলো, স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীকে এবং স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীকে ক্ষেপিয়ে তুলে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরানো। অনুরূপভাবে অনেক কর্মজীবি অফিসের বস কিংবা দায়িত্বশীলের নিকট অন্য কোনো কর্মজীবির কথা তুলে ধরে। এতে তার উদ্দেশ্য উক্ত কর্মজীবির ক্ষতি সাধন করা এবং নিজেকে উক্ত দায়িত্বশীলের শুভার্থী বা খয়েরখাঁ হিসাবে তুলে ধরা। এসব কাজ চোগলখুরী হিসাবে গণ্য এবং তা হারাম।
এমন দুষ্ট লোক নিঃসন্দেহে আমরা সকলেই কোথাও না কোথাও দেখেছি। মাদরাসা বা স্কুলে বা বাসায় বা পাড়া-মহল্লায় বা অফিসে-আদালতে এমন কোন জায়গা বাদ নেয়, যেখানে এসব দুষ্ট লোক নিজেদের দুষ্ট নফসকে তৃপ্তি দেয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের নসিহত করা, তাদের সতর্ক করা। কারণ, আশংকা থাকে যে, তারা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের মাঝে এ দোষটাও বড় হতে থাকবে। এভাবে এক সময় তারা হাদিসে বর্ণিত ধমকের আওতায় পড়ে যাবে।
[ ফায়দা ]
১। প্রতিটি জিনিসকে আমাদের সমাজের ঠিক করে দেওয়া মাপকাঠিতে নয়; বরং প্রতিটি জিনিসকে মাপতে হবে শরীয়তের মাপকাঠিতে। যদি আমরা এ হাদিসটা সম্পর্কে অবগত নাও হতাম, তখন আমাদের কেউ চোগলখুরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে অবশ্যই আমরা তাকে এ জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতাম। কিন্তু আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না যে, চোগলখোর জান্নাতে যাবে না! কিন্তু এ হাদিসটি এসে আমাদের চোগলখুরির অপরাধতা শরীয়তের দৃষ্টিতে কতটা গুরুতর, তা আমাদের জানানো হয়েছে। এ হাদিস বলছে, চোগলখুরি কবিরা গুনাহ এর অন্তর্ভূক্ত।
২। তাহলে আমরা কি চোগলখোরকে জাহান্নামি বলব? না। আমরা কোনো চোগলখোরকে জাহান্নামি বলব না। বরং, আমরা তাকে এ হাদিসটি শুনিয়ে দেব, যেন সে ভয় পেয়ে চোগলখুরি থেকে বিরত থাকে। কারণ, একমাত্র আল্লাহই মানুষের ব্যাপারে ফয়সালা দিয়ে থাকেন যে, কে জান্নাতি আর কে জাহান্নামি। আমাদের এমন ফয়সালা দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
[ করণীয় ]
- চোগলখোর যা করে, তার উল্টোটা করব।
- আমরা যদি পারি এক বন্ধুর বলা ভালো কথা, অপর বন্ধুর কাছে পৌঁছে দেব। নচেৎ চুপ থাকব।
- চোগলখোরদের চোগলখুরি করার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য নিম্নোক্ত কুরআনের ১৭ নম্বর সূরা আল-ইসরার ৫৩ নম্বর আয়াত পাঠ করে নসিহত করা যায়ঃ
وَقُلْ لِّعِبَادِىۡ يَقُوۡلُوا الَّتِىۡ هِىَ اَحۡسَنُؕ
❛ আমার বান্দাদের বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথায় বলে; ❜ (5)
(1) সূরা আল-ক্বলাম (৬৮ঃ ১০-১১)
(2) সূরা আল-হুমাযাহ, (১০৪ঃ১)
(3) সহিহুল বুখারি, ৬০৫৬ । সহীহ মুসলিম, ১৯১ । হাদিসের মানঃ সহিহ
(4) সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬০৫৫;
(5) সূরা আল-ইসরা (১৭ঃ৫২)
বইঃ হাদিস পড়ি আদব শিখি
লেখকঃ শাইখ আলী জাবির আল-ফাইফি
প্রকাশকঃ রুহামা পাবলিকেশন